মার্কিন টকশো উপস্থাপক অপরাহ উইনফ্রে-এর সঙ্গে ডিউক ও ডাচেস অফ সাসেক্স প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কেলের বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার বেশকিছু কারণে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে একটা কারণ হলো প্রিন্স হ্যারি এই সাক্ষাৎকারে বহু বার তার মা প্রিন্সেস ডায়ানার নাম উল্লেখ করেছেন।
মেগান মার্কেলও বলেছেন ব্রিটিশ রাজপরিবারে বিয়ে করার পর তার ওপর চাপ নিয়ে তিনি কথা বলেছিলেন ডায়ানার বন্ধুদের সঙ্গে। তার ভাষায়, ‘কারণ… ওই পরিবারের ভেতরে থাকাটা আসলে যে কী রকম চাপের তা আর কে বুঝতে পারতো?’ ব্রিটিশ রাজপরিবারে এই দুই নারীর অভিজ্ঞতার মধ্যে মিল টানা হচ্ছে।
প্রিন্স হ্যারি বলেছেন, তার আশঙ্কা হয়েছিল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এরপর তিনি ও মেগান রাজপরিবারের ঊর্ধ্বতন সদস্য হিসাবে তাদের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।
ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলো তার মা প্রিন্সেস ডায়ানার প্রতি যে ধরনের আচরণ করেছিল, সেই কাগজগুলো তার স্ত্রী মেগানের প্রতিও যে একই ধরনের আচরণ করেছে সে কথাও হ্যারি উল্লেখ করেছেন। যদিও এ কথা তিনি আগেও বলেছেন।
প্রিন্সেস ডায়ানা পৃথিবীতে সবচেয়ে বিখ্যাত নারীদের অন্যতম। প্রায়ই তাকে নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখি হয়েছে। এসব লেখায় এসেছে তার দাতব্য কাজকর্ম এবং পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত জীবনের নানা শিরোনাম হয়ে উঠা ঘটনা।
রাজপরিবার বিষয়ে একজন লেখিকা কেটি নিকল। বিবিসি রেডিও ওয়ানের নিউজবিট অনুষ্ঠানকে তিনি বলেছেন, ‘রাজপরিবারে তিনি (ডায়ানা) সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি, তার জায়গা কেউ নিতে পারেনি। বিশ্বজুড়ে তার ব্যাপক পরিচিতি ও স্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি বিশাল জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।’
কেটি এ কথাও বলেছেন যে, ডায়ানাকে নিয়ে সব সময়ই যে ইতিবাচক খবর হয়েছে তেমনটা নয়। কেটি নিকল-এর ভাষায়, ‘সংবাদমাধ্যমে ডায়ানাকে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে। ডায়ানা যেহেতু বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তাই ছবি শিকারী প্যাপারাজ্জিরা প্রিন্স উইলিয়াম আর হ্যারিকেও অনবরত তাড়া করে বেড়াতো।’
সাংবাদিক জেমস ব্রুকসও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘কোনও কোনও সময় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ডায়ানার খুবই ভালো সম্পর্ক দেখা যেতো। তারা তার সঙ্গে খুবই ভাল আচরণ করতো। তার পক্ষ নিয়ে কথা বলতো। আবার অনেক সময় ডায়ানা মিডিয়ার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত নাক গলানোর অভিযোগ করতেন। একটা মিশ্র সম্পর্ক ছিল।’
জীবনের শেষ বছরগুলোতে ডায়ানা নিজেই সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। যার থেকে কেউ কেউ মন্তব্য করতেন যে, তিনি প্রচারণা চাইছেন এবং তার ব্যাপার সামনে আনার জন্য সংবাদমাধ্যমে উৎসাহ দিচ্ছেন। অন্যদিকে মেগান রাজপরিবারের বৌ হয়ে আসার পর তার ব্যক্তিগত ব্লগ বন্ধ করে দেন। অপরাহ উইনফ্রে-এর সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারের আগে তিনি যা বলেছেন তার অধিকাংশই ছিল তার দাতব্য কাজকর্মকে ঘিরে। তবে কেটি নিকল বলছেন, কেউ কেউ মনে করছেন মেগান ও হ্যারি পরস্পরবিরোধী কিছু কথা বলেছেন।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে হ্যারি ও মেগান দম্পতি জানান, রাজপরিবারের ঊর্ধ্বতন সদস্য হিসেবে তাদের দায়িত্ব থেকে তারা সরে দাঁড়াচ্ছেন। তারা কানাডায় চলে যান, সেখান থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায়। সম্প্রতি তারা ঘোষণা করেন যে, তারা ব্রিটিশ রাজপিরবারের সদস্য হিসাবে আর যুক্তরাজ্যে ফিরবেন না। কেটি নিকল বলছেন, ‘আমেরিকায় যাবার পর সেখানে তাদের জীবন সম্পর্কে এই দম্পতি অনেক বিস্তারিত খবর দিয়েছেন এই সাক্ষাৎকারে। যুক্তরাজ্যে তাদের জীবন সম্পর্কে তারা কখনোই এতোটা খোলামেলা কথা বলেননি।’
রাজপরিবারের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পর এই দম্পতি স্পটিফাইতে পডকাস্ট শুরু করেছেন। নেটফ্লিক্সের সঙ্গে একটি চুক্তিতে তারা সই করেছেন। জেমস কর্ডেন এবং অপরাহ উইনফ্রেকে তারা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
কেটি নিকল বলছেন, এই দম্পতি শান্তিপূর্ণ জীবন চেয়েছেন বলেই সেখানে চলে গেছেন; এমন কথাও কেউ কেউ বলেছেন। তাদের প্রশ্ন, নাহলে কেন তারা জেমস কর্ডেন এবং অপরাহ উইনফ্রেকে সাক্ষাৎকার দিয়ে তাদের ছেলে সম্পর্কে এতো বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরলেন? তবে ব্রিটেনে থাকতে না যাওয়া এবং সংবাদমাধ্যমকে এড়ানোই যে তাদের দেশত্যাগের সত্যিকার কারণ, তা অনেক মানুষই বিশ্বাস করছেন না।
প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যু ও প্যাপারাজ্জি
‘যেখানেই তিনি গেছেন তার প্রতিটি পদক্ষেপের খবর দিতে বিশাল সংখ্যক সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী তার পেছন পেছন সেখানে গেছেন।’ বলছিলেন জেমস ব্রুকস। জেমস মনে করেন সংবাদমাধ্যমের ব্যাপারে হ্যারির মতামতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার মা প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর ঘটনা। তিনি বলেন, ‘মিডিয়া সম্পর্কে হ্যারি আর উইলিয়ামের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের মায়ের মৃত্যুর কারণে কলুষিত হয়ে গেছে। কারণ তাদের চোখে প্যাপারাজ্জিরা (ছবি শিকারী) তার জীবন অনবরত উত্যক্ত করে তুলেছিল।’
নেগেটিভ কাভারেজ
কেটি নিকল বলছেন, প্রিন্স হ্যারি ২০১৯-এর অক্টোবরে একটি বিবৃতি দেবার পরেও তার ধারণা প্যাপারাজ্জিরা যেভাবে ডায়ানাকে তাড়া করে ফিরতো তারা সেভাবে মেগানের পেছনে হয়তো লাগেনি। তবে তিনি মনে করেন মেগানকে বারবার সমালোচনা করে খবর লেখা নিয়ে হ্যারি স্পষ্টতই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। যেসব সাংবাদিক সারাক্ষণ তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাব তৈরিতে ইন্ধন দিচ্ছেন তিনি (হ্যারি) তাদের সমালোচনা করেছেন। কেটি নিকল বলেন, ‘অর্থ খরচ নিয়ে অসংখ্য নেতিবাচক কাহিনি লেখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের বাসা মেরামতের পেছনে জনসাধারণের করের অর্থ খরচ করার কাহিনী।’ হ্যারি ও মেগান দম্পতি এ বাবদ খরচ করা ২৪ লাখ পাউন্ড পরে ফিরিয়ে দেন।
জনগণের নজরে থাকা তার জন্য নতুন নয়
কেউ কেউ বলছেন মেগানের সঙ্গে প্রিন্সেস ডায়ানার তফাত হলো মেগান মানুষের নজর থেকে মুখ লুকিয়ে থাকার মতো মেয়ে নন। হ্যারিকে বিয়ে করার আগে তিনি একজন তারকা ছিলেন। কিন্তু এমন মতামতের সঙ্গে একমত নন কেটি নিকল। তিনি বলেন, মেগান বিয়ের আগে তারকা জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন ঠিকই, কিন্তু রাজপরিবারের সদস্য থাকার সঙ্গে তার তুলনা চলে না।
কেটি বলছেন, সমস্যা হল হ্যারি ও মেগান সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ প্রচুর। কিন্তু সেই আগ্রহ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে কিনা, যা বলা হচ্ছে তা কতটা গ্রহণযোগ্য সমস্যাটা সেখানেই। সংবাদমাধ্যম রাজপরিবারের সদস্যদের নিয়ে খবর করবে, সেটা তাদের কাজ। কিন্তু সেটা ন্যায্য ও বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে।
সূত্র: বিবিসি।