শেখ রিয়াদ মুহাম্মদ নুর : নানামুখী জল্পনা কল্পনা ও নাটকীয়তার মধ্যদিয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের নির্বাচন সম্পন্ন ও বিজয়ী প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এখনও নাটকীয়তার অবসান হয়নি। কেননা যে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই উচ্চ আদালতই নির্বাচনের ফলাফল ও দায়িত্ব হস্তান্তরের ওপর তিন মাসের স্থগিতাদেশ প্রদান করেছেন।
গত ৭ই জানুয়ারি প্রেসক্লাবের সদস্য ও বিগত নির্বাচনের প্রার্থী আরিফিন তুষার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে বেশকিছু গুরুতর অভিযোগ উল্লেখ করে মহামান্য উচ্চ আদালতে একটি রীট মামলা দায়ের করেন। এছাড়াও প্রেসক্লাবের বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককেও বিবাদী করা হয়েছে।
রীট মামলার বিষয়ে আরিফিন তুষার-এর কাছে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, যেহেতু মামলাটি মহামান্য উচ্চ আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে সেহেতু এখন এই বিষয়ে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। তবে আমি একটুকু বলতে পারি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার নানা অনিয়ম করেছেন এবং কারচুপির মাধ্যমে আমাকে পরাজিত করা হয়েছে।
অপরদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আমজাদ হোসেন বলেন, নির্বাচনে কোন ধরনের অনিয়ম হয়নি বরং নির্বাচন আয়োজন করার যে দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছিল তা বিধি মোতাবেক সুষ্ঠু ভাবে পালন করেছি। রীট মামলা মোকাবেলার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আমজাদ হোসেন আরও বলেন, এই বিষয়ে আমার কোন কিছুই করনীয় নেই, যা করার তা প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ করবেন।
আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অনলাইন নববার্তা-কে জানাতে ই-মেইল করুন- nobobarta@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
যদিও প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন আদালতের বিচারাধীন বিষয়ে কোন ধরনের মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করলেও আইননুসারে যা যা করনীয় তা করবেন বলে জানিয়েছেন। অবশ্য প্রেসক্লাবের সভাপতি মানবেন্দ্র বটব্যাল বলেছেন, রীট মামলার বিষয়ে শুনেছি তবে এসংক্রান্ত কোন কাগজপত্র পাইনি। কাগজপত্র হাতে পেলে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
কিন্তু বিগত নির্বাচনে বিজয়ী সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী কাজী মিরাজ-এর কাছে রীট মামলার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমি হতবাক হয়েছি, তবে আরিফিন তুষার-এর দোষ দেব না, প্রেসক্লাবের পদ-পদবী ব্যবহার করে যে স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছেন তারাই এই রীট মামলার মূল কুশীলব। অচিরেই আমরা এই অন্যায়ের প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবো, প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করবো৷
রীট মামলা মোকাবেলা করার কোন উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা তা জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, আমরা বিষয়টি গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি, যদি প্রেসক্লাবের বর্তমান কমিটি কোন প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ না করেন তাহলে আমরা প্রেসক্লাবের সদস্যদের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে পক্ষভুক্তির মাধ্যমে রীট মামলাটি মোকাবেলা করবো, প্রয়োজনে আপীল বিভাগে যাব।
এই বিষয়ে বরিশাল মেট্রোপলিটন প্রেসক্লাবের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি বরিশাল প্রেসক্লাবের নির্বাচিত সভাপতি ছিলাম কিন্তু অন্যায় ভাবে আমার সদস্য পদ বাতিল করে দেয়া হয়েছি, আমি চাইলে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে নির্বাচন বন্ধ করতে পারতাম কিন্তু সেই নোংরামি না করে ভদ্রভাবে দেওয়ানী মামলা করেছি এবং আমি বিশ্বাস করি ন্যায়বিচার নিশ্চয়ই পাব। কিন্তু এই ধরনের রীট মামলা মহান কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত-এর নাম বিজড়িত প্রেসক্লাবের মর্যাদা ভূলন্ঠিত করছে। আমি আশাকরি সংশ্লিষ্ট পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং ঐতিহ্যবাহী প্রেসক্লাবটি তার মর্যাদা ফিরে পাবে। অবশ্য বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন বিধায় কোন মন্তব্য করেননি প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এস এম ইকবাল।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রেসক্লাবের একজন জৈষ্ঠ্য সদস্য চলমান অচলাবস্থার বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, প্রেসক্লাবে একটি কমিটি গিয়ে আর একটি কমিটি এলেই সমস্যার সমাধান হবে না। কেননা এখানে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে সকল পক্ষের ঐক্যমত্য রয়েছে। এজন্যই এখানে নতুন সদস্য নেয়ার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। তাই সবার আগে প্রেসক্লাবের দ্বার তরুণ সাংবাদিকদের জন্য উম্মুক্ত করতে হবে, অন্যায়ভাবে যাদের সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে ক্ষমা চেয়ে তাদের সদস্যপদ ফিরিয়ে দিতে হবে। তাহলেই একদিন প্রেসক্লাবটি তার হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে। অন্যথায় অনন্তকাল ধরে এসব চলতেই থাকবে।
অবশ্য এই নির্বাচন নিয়ে মামলার শুরু হয়েছিল গত বছরের ১৩ই ডিসেম্বর। তখন বরিশাল থেকে প্রকাশিত দৈনিক কলমের কন্ঠ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক মো. আরিফ হোসেন মোল্লা ও দৈনিক ভোরের কাগজ-এর বরিশাল প্রতিনিধি এম.কে. রানা বাদী হয়ে নির্বাচন বন্ধের আবেদন জানিয়ে নিন্ম আদালতে মামলা দায়ের করেছিলেন। বিজ্ঞ আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে প্রেসক্লাব সভাপতি-সম্পাদক ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। পাশাপাশি দোতরফা শুনানি না হওয়া পর্যন্ত উভয়পক্ষকে স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। একইসাথে চলতি বছরের ২রা ফেব্রুয়ারি মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছিল।
কিন্তু আদালতের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আমজাদ হোসেন নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলমান রেখে বৈধ প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেন। ফলে অপর দুই নির্বাচন কমিশনার দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী ও রফিকুল ইসলাম যথাক্রমে ১৯ ও ২০ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। নিয়মমাফিক নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের অনুরোধ না জানিয়ে প্রেসক্লাবের একজন সদস্যকে সহায়তাকারী নিযুক্ত করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার আমজাদ হোসেন। যদিও বিধি অনুযায়ী প্রেসক্লাবের কর্মচারীদের সহায়তাকারী হিসেবে নিযুক্ত করার বিধান থাকলেও কোন সদস্যকে সহায়তাকারী হিসেবে নিয়োগ দেয়া বৈধ নয়। উপরন্তু একটি পক্ষের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় গত ২২ ডিসেম্বর নিন্ম আদালতের নির্দেশনার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার আমজাদ হোসেন এবং যথারীতি উচ্চ আদালত থেকে নিন্ম আদালতের নির্দেশনার উপর স্থগিতাদেশ নিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যান। যথেষ্ট সময় থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের অনুরোধ না জানিয়ে বিধিভঙ্গ করে একজন সহায়তাকারী নিয়োগ দিয়ে এক সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন করেন তিনি। ফলে আপাতদৃষ্টিতে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হলেও নির্বাচনের আগেই প্রক্রিয়াগত ভাবে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে৷
অথচ তাড়াহুড়া না করে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হলে আজকের এই অচলাবস্থা সৃষ্টি হতো না। তবে প্রেসক্লাবের বহু সদস্য, সহযোগী সদস্য ও সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে যে, বরিশাল প্রেসক্লাবে একটি শক্তিশালী দুষ্টচক্র কয়েক যুগ ধরে অধিপত্য বিস্তার করে আছে এবং মামলা পাল্টা মামলায় চলমান সমস্যার টেকসই সমাধান হবে না। এইজন্য প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে সদস্য পদ লাভের প্রক্রিয়া সহজিকরণ ও অতীতে গৃহীত সকল অন্যায় ও অনৈতিক সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।