মোঃ সাইফুল্লার রাব্বী : বাংলাদেশ পৃথিবীতে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অন্যতম এক ব-দ্বীপ।যার বুক জুড়ে আছে শত শত দ্বীপ।আর শত শত দ্বীপের মাঝে লুকিয়ে আছে শত শত সম্ভাবনা। যে সব দ্বীপের সম্ভাবনা সমৃদ্ধ করে দিতে পারে বাংলাদেশ পর্যটনকে। তাই বলতে ইচ্ছে হয় বাংলাদেশে দ্বীপ-ভিত্তিক পর্যটন এখন সময়ের দাবি।
কেন বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে বৃহত্তম ব-দ্বীপ, কেনই বা তার বুকে শত শত দ্বীপ? উত্তরটা তাহলে সহজভাবে বলে ফেলি- ভারতীয় পাহাড়ী ঢল আর নদীর তীব্র স্রোত নদী মোহনায় গতি হারিয়ে নদীবাহিত কাদা , পলি, বালি , কাঁকর , নুড়ি প্রভৃতি স্তরে স্তরে জমাট বেধে যে ত্রিকোণাকৃতি ভূমিরুপ থেকে সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর বুকে বৃহত্তম ব-দ্বীপ সোনার বাংলাদেশ।তার বুক চিরে আছে শত শত নদী আর নদীগুলো নিজ মহিমায় সৃষ্টি করেছে দ্বীপগুলোকে।সবগুলো নদীকে বুকে টেনে নিয়েছে বঙ্গ-নদীমাতা বঙ্গোপসাগর।যাকে বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর।
বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি পর্যটন সম্ভাবনাময় দ্বীপ আছে যাদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে দ্বীপ-ভিত্তিক জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।মালদ্বীপের দ্বীপঅঞ্চলের আদলে সাজানো যেতে পারে বাংলাদেরশের দ্বীপঅঞ্চলগুলোকে।যে দ্বীপগুলোতে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে সেগুলো হচ্ছে-বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড, মহেশখালী দ্বীপ,সোনাদিয়া দ্বীপ,কুতুবদিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপ,ছেঁড়া দ্বীপ,শাহপরীর দ্বীপ,মনপুরা দ্বীপ উল্লেখযোগ্য।
বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড-সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত একটি দ্বীপ। সুন্দরবন উপকূল দুবলার চর-হিরন পয়েন্ট থেকে ১০ নটিক্যাল মাইল দূরে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে উঠা এই দ্বীপটি খুবই পর্যটন সম্ভাবনায় সমৃদ্ধ।এ দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ লাল কাঁকড়া। চলতি বছর দ্বীপটি নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলাম জানিয়েছেন, দ্বীপটিতে কোনো চোরাবালির চিহ্ন পাওয়া যায়নি।প্রায় নয় কিলোমিটারের লাল কাকড়ার সৈকতটি পর্যটকদের সহজেই নজর কাড়তে পারে।
আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অনলাইন নববার্তা-কে জানাতে ই-মেইল করুন- nobobarta@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
নিঝুম দ্বীপ-নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে উঠা এক খন্ড সম্ভাবনার নাম সাইল্যান্স আইল্যান্ড। যার প্রতিটি অংশ এক একটি সম্ভাবনায় ভরপুর।বল্লার চর,কামলার চর,চর ওসমান ও চর মুরি এই চারটি চরের মিলনে ১৪০৫০ একর জায়গার উদয় হয়েছিল একঝাক মৎস্যজীবীদের হাত দিয়ে।যা পরিচিতি পায় ওসমানীর চর,স্বণ দ্বীপ ও সবশেষে নিঝুম দ্বীপ হিসেবে।নিঝুম দ্বীপে যাবার পথে দেখা মিলবে কালা মহিষের চর,কবিরের চর, চৌধুরীর দ্বীপ।ম্যানগ্রোভ বন আর ডোরা কাটা হরিন দ্বীপটিকে বাংলাদেশের বাকিসব দ্বীপ থেকে আলাদা আবেদন সৃষ্টি করেছে।এখানকার বৈচিত্রতা সংরক্ষণ করার জন্য ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার নিঝুম দ্বীপের প্রায় ৯০৫০ একর জায়গা জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষনা করেছে। দ্বীপটির অনন্য আবেদন থাকায় প্রকৃতি প্রেমিদের নজরে আসায় দিন দিন পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্যটন সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে।
মহেশখালী দ্বীপ- কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়িয়া দ্বীপ যেটি মহেশখালী উপজেলা নামেও পরিচিত।এই দ্বীপটি হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান তিন ধর্মের লোকের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ।আদিনাথ পাহাড়ের চূড়ায় আদিনাথ মন্দির, পাহাড়ের পাদদেশে গ্রামের মাঝে বৌদ্ধ মন্দির,সারি সারি পানের বরজ়,বার্মিজ মার্কেট,শুটকির বাজার আরো হরেক রকমের জিনিস চোখে পড়বে বঙ্গোপসাগরের গভীরে এই দ্বীপটি ।দিন দিন এখানে পর্যটকদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।প্রয়োজন শুধু পর্যটনবান্ধব পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা।
সোনাদিয়া দ্বীপ-কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার অন্তর্গত কুতুবজোমে অবস্থিত জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ একটি দ্বীপ।এখানে পৃথিবীর কিছু দুর্লভ পাখির দেখা মেলে যেটা অন্য কোথও সম্ভব নয়।প্রায় নয় কিলোমিটারের এই দ্বীপটি তিন দিকে সমুদ্র সৈকত,মাঝে মাঝে ছোট –বড় খাল বিশিষ্ট প্যারাবন,উপকূলীয় বনভূমি,বিচিত্র প্রজাতির জলচর পাখি দ্বীপটিকে পর্যটকদের কাছে করে তুলেছে অতুলনীয়।এখানে গড়ে উঠেছে দেশের সবথেকে বড় শুটকি মাছ উৎপাদন কেন্দ্র।বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে গড়ে তোলা হচ্ছে সোনাদিয়া ট্যুরিজম পার্ক যেটা এখানকার পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
কুতুবদিয়া দ্বীপ-কক্সবাজার জেলার একটি উপজেলা যেটি কুতুবদিয়া দ্বীপ নামে পর্যটকদের বেশি জনপ্রিয়।প্রায় ২১৬ বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপটির যে স্থান গুলোতে ভ্রমণ পিপাসুদের আনাগুনা লক্ষ্য করা যায়- বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প (বায়ুকল),কুতুব শরীফ দরবার, কুতুব আউলিয়ার মাজার, বড়ঘোপ সমুদ্র সৈকত, প্রাকৃতিক উপায়ে লবণ তৈরির মাঠ,কুতুবদিয়া বাতিঘর, বড়ঘোপ সরকারি স্টেডিয়াম, কালারমার মসজিদ, ফকিরা মসজিদ, ধুরুং স্টেডিয়াম,প্রাচীন দীঘির পাড় ইত্যাদি।
মনপুরা দ্বীপ-ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলায় মেঘনা নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরের এক অংশ জুড়ে এই দ্বীপটির অবস্থান। প্রায় ৩৭৩ বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপ।বনবিভাগের প্রচেষ্টায় এখানকার দশটি চরে বনায়ন কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে। যেটি ভ্রমণ পিপাসুদের মানুষের নজরে আসতে শুরু করেছে। জীববৈচিত্র ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এখানকার পর্যটন আকষণ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে এটা দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে জায়গা করে নিবে।
শাহপরীর দ্বীপ-টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এই দ্বীপটি।বাংলাদেশের স্থলভাগের একেবারের দক্ষিণ সীমান্তের নাম এরপর বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে বিস্তৃত জলরাশি। এখনকার মানুষের প্রধান কাজ মাছ শিকার ও লবণ চাষ করা।নয়নাভিরাম সৌন্দর্য পর্যটকদের এখানে ঘুরতে আসতে বাধ্য করবে।
সেন্ট মার্টিন্স ও ছেঁড়া দ্বীপ-বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি যে দ্বীপে মানুষ ঘুরতে যায় তার নাম সেন্ট মার্টিন্স আইল্যান্ড।যেখানে চোখে পড়ে নীলাভ স্বচ্ছ জল, শত শত নাড়িকেল গাছ,বিভিন্ন রকমের সামুদ্রিক মাছ,বৈচিত্রময় স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা,হাজারো প্রবালের আশ্রয়কেন্দ্র,নানা বৈচিত্রতার সমাহার।বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ।বাংলাদেশের সবশেষ দক্ষিণের স্থানটি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে ছেড়া দ্বীপ।
বাংলাদেশের দীপাঞ্চলগুলো প্রাকৃতিগত ভাবেই বৈচিত্রময়।এখানকার দ্বীপগুলো আলাদা আলাদা আবেদন নিয়ে স্থান করে নিয়েছে পর্যটন মানচিত্রে। যথাযথ পরিকল্পনা,প্রচারণা ও ব্যবস্থাপনাই পারে দ্বীপ-ভিত্তিক পর্যটনকে সম্ভাবনার জায়গা থেকে অর্থনৈতিকভাবে অবদান রাখতে।
মোঃ সাইফুল্লার রাব্বী
প্রভাষক, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ড্যাফোডিল ইনিস্টিউট অব আইটি।
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান – বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ট্যুরিজম ইনোভেশন